পাপ প্রকাশের ভয়াবহতা এবং তওবার গুরুত্ব | The awfulness of sin and the importance of repentance
❐ পাপ প্রকাশের ভয়াবহতা এবং তওবার গুরুত্ব:
আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যেখানে পাপ করে বলে বেড়ানোটা smartness! প্রকাশ্যে বিভিন্ন পাপ কাজ করাটা যেন কালচার হয়ে দাঁড়িয়েছে! বিশেষ করে ইয়াং জেনারাশনের মধ্যে এটা বেশি পরিলক্ষিত হয় যে, তারা বন্ধুমহলে নিজের পাপের কথা নিজেরাই নির্লজ্জের মতো আলোচনা করে, ক্লাসে এসব নিয়ে আড্ডা মারে আর হাসি-তামাশা ও গল্প-গুজব করে। তাদের বড় ভাই ও আপুরা, এমনকি অনেক শিক্ষক ও অভিভাবকরা তাদের সাবধান করবে কী, উল্টো সমর্থন করে! হালাল-হারামের বাউন্ডারি তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। লজ্জাশীলতা যে ঈমানের অংশ [Bukhari 24], এটা তারা জানেই না!
ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে এখন ফ্রি-মিক্সিং, বেহায়াপনা ও অশ্লীলতাই আধুনিকতা! নাউযুবিল্লাহ! অথচ আল্লাহর কাছে পাপ মাফ হওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো, পাপের কথা গোপন রাখা এবং কৃত পাপের জন্য তওবা ও ইস্তিগফার করা। আর কোনো বান্দার হক নষ্ট করলে তা পূরণ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা। পাশাপাশি যেই হালাল পদক্ষেপ গ্রহণ করলে পাপের ইচ্ছা ও রাস্তা বন্ধ হবে, খুব দ্রুত সেই ব্যবস্থা করা। [যেমন, কেউ যদি মনে করে যে, বিয়ে করলে গোপন গুনাহ ও ফিতনা থেকে নিজেকে সহজেই বাঁচাতে পারবে, তাহলে দ্বীনি কাউকে বিয়ে করে নেওয়া।] এভাবে ঈমানের সাথে তওবা করে ফিরে এলে ও সৎকাজ করলে আল্লাহ (ﷻ) শুধু মাফই করেন না, গুনাহগুলোকে সওয়াবে পরিণত করে দেন! সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ (ﷻ) বলেন–
◈ “তবে যে তওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, পরিণামে আল্লাহ (ﷻ) তাদের পাপগুলোকে পূণ্য দ্বারা প্রতিস্থাপন করে দেবেন। আল্লাহ (ﷻ) অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [25:70]
কিন্তু আজ অনেক মুসলিম এটা জানে না বা বুঝতেই চায় না যে, কোনো গুনাহ করলে গুনাহর কথা কারও সাথে শেয়ার করা সম্পূর্ণ হারাম—এমনকি গুনাহ করার চেয়েও বড় গুনাহ হলো গুনাহর কথা কাউকে বলে দেওয়া! আর কারো দ্বারা মানুষজন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাপাচারে অনুপ্রাণিত হলে, যত মানুষ তার পদচারণ অনুসরণ করে গর্তে পড়বে (গুনাহয় জড়াবে), সকলের গুনাহর ভার তার একাউন্টে জমা হবে! নাস্তাগফিরুল্লাহ! [‘আস্তাগফিরুল্লাহ’-এর বহুবচন] রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন–
◈ “যে ব্যক্তি সৎপথের দিকে ডাকবে সে তার সকল অনুসারীদের সমান সওয়াব পাবে। অপরদিকে যে ব্যক্তি ভ্রষ্টতার দিকে ডাকবে সে তার সকল অনুসারীদের সমান পাপের বোঝা বহন করবে।” [Muslim 2674 & Abu Dawud 4609]
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জ্ঞাতব্য। কেউ যদি আল্লাহর অবাধ্যতায় বা কবিরা গুনাহয় লিপ্ত থাকে, ওপেনলি কোনো হারাম কাজ করে বা আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করে, তাকে ফাসিক (evil doer) বলে—যা তাকে কুফরির দিকে নিয়ে যেতে পারে। ইসলামি কোর্টে ফাসিকের সাক্ষী গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ (ﷻ) বলেন–
◈ “হে ঈমানদারগণ, যদি কোনো ফাসিক (মিথাবাদি, আল্লাহর অবাধ্যতাকারী, কবিরা গুনাহগার) তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা যাচাই করে নাও। তা না হলে তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতি করে বসবে, অতঃপর তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হবে।” [49:6]
[যেমন, টিভিতে ক্লিন শেভেড বা বেহিজাবি নিউজরিডারের খবর শুনে আজ নামধারী মুসলিমরা দাড়ি-টুপি-হিজাবওয়ালা মুসলিমদের অপছন্দ করে বা জঙ্গি ভাবে, প্রকৃত ইসলামকে মৌলবাদ বলে কটাক্ষ করে! নাউযুবিল্লাহ!]
কোনো অপকর্ম বা গুনাহর কাজ প্রকাশ্যে করলে অথবা গোপনে করে তা কাউকে বলে দিলে এর অনেক সামাজিক সমস্যা আছে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো, ধীরে ধীরে মানুষের মন থেকে সেই পাপবোধটা উধাও হয়ে যায়—মানুষ একটা পর্যায়ে সেই পাপটাকে আর পাপ মনে করে না! পাপটা তখন সবার কাছে নরমাল ও কমন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় এবং নতুন প্রজন্মের কাছে তা সহজে গ্রহণযোগ্যতা পায়। দ্বিতীয়ত, সেই পাপকে কেন্দ্র করে আরও নতুন নতুন পাপের আবির্ভাব ঘটে ও বিভিন্ন বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, যা অপূরণীয় ক্ষতি বয়ে আনে। ফলে মানবজীবনে, পরিবারে ও রাষ্ট্রে শান্তি ও ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়।
আল্লাহ (سبحانه وتعالى) কুরআন মাজিদে আমাদেরকে বলেন–
◈ “যারা কোনো অশ্লীল কাজ করলে অথবা নিজদের প্রতি যুলম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে, অতঃপর তাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা চায়। আর আল্লাহ (ﷻ) ছাড়া কে গুনাহ ক্ষমা করবে? আর তারা যা করেছে, জেনে-বুঝে তা তারা বার বার করে না।” [3:135]
◈ “এমন লোকেদের তওবা নিস্ফল যারা গুনাহ করতেই থাকে, অতঃপর মৃত্যুর মুখোমুখী হলে বলে, ‘আমি এখন তওবা করছি।’ আর তওবা তাদের জন্যও নয়, যারা কাফির অবস্থায় মারা যায়। আমি এদের জন্য ব্যবস্থা করেছি যন্ত্রণাদায়ক আযাব।” [4:18]
◈ “আল্লাহ (ﷻ) চান তোমাদের তওবা কবুল করতে। কিন্তু যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তারা চায় যে, তোমরা (আল্লাহর নিকট হতে) বহু দূরে সরে যাও।” [4:27]
◈ “যে ব্যক্তি মন্দ কাজ করবে কিংবা নিজের প্রতি যুলম করবে, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে, সে আল্লাহকে অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু পাবে।” [4:110]
◈ “তিনি তোমাদেরকে আহ্বান করেন যাতে তিনি তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করেন এবং তিনি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদেরকে অবকাশ দেন।” [14:10]
◈ “হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজদের ওপর বাড়াবাড়ি করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ (ﷻ) সকল পাপ ক্ষমা করেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [39:53]
◈ “তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও—নিশ্চয় তিনি পরম ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের ওপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষাবেন আর তোমাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তানাদি দিয়ে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের দেবেন বাগ-বাগিচা ও নদী-নালা।” [71:10-12] [Also see Quran 4:17; 7:156; 11:52 & 66:8]
বিশেষ করে শিরক না করে মারা গেলে এবং মৃত্যু আসার পূর্বে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ সকল পাপই ক্ষমা করবেন [Tirmidhi 3540]। আল্লাহর শেষ ও সর্বজনীন রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ) বলেন–
◈ “আমার উম্মতের সবাইকেই মাফ করে দেওয়া হবে, শুধু ‘মুজাহিরিন’ ব্যতীত (অর্থাৎ যারা নিজের পাপ নিজেরাই প্রকাশ করে দেয় বা যারা প্রকাশ্যে পাপ করে)। আর নিশ্চয় এ বড়ই অন্যায় যে, কোনো লোক রাতে অপরাধ করল, যা আল্লাহ (ﷻ) গোপন রাখলেন, কিন্তু সে সকাল হলে বলে বেড়াতে লাগল, ‘হে অমুক! আমি রাতে এই এই কাজ করছি।’ অথচ সে এমন অবস্থায় রাত কাটাল যে, আল্লাহ (ﷻ) তার কুকর্ম লুকিয়ে রেখেছিলেন আর সে ভোরে উঠে তার ওপর আল্লাহর দেওয়া আবরণ খুলে ফেলল!” [Bukhari 6069]
◈ “কিয়ামাতের দিন মুমিনকে আল্লাহর নৈকট্য দেওয়া হবে। মুমিন নিকটবর্তী হবে, এমনকি আল্লাহ (ﷻ) তাকে স্বীয় পর্দায় ঢেকে নেবেন এবং তার নিকট হতে তার গুনাহসমূহের স্বীকারোক্তি নেবেন। আল্লাহ (ﷻ) জিজ্ঞেস করবেন, ‘অমুক গুনাহ সম্পর্কে তুমি জান কি?’ বান্দা বলবে, ‘হে আমার রব! আমি জানি, আমি জানি।’ তখন আল্লাহ (ﷻ) বলবেন, ‘আমি দুনিয়ায় তোমার পাপ গোপন রেখেছিলাম। আর আজ তোমার পাপ ক্ষমা করে দিচ্ছি।’ তারপর তার নেক আমালনামা গুটিয়ে নেওয়া হবে।” [Bukhari 4685]
◈ “মুসলিম মুসলিমের ভাই। … যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ ঢেকে রাখবে, আল্লাহ (ﷻ) কিয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন।” [Bukhari 2442]
বেশ কিছু পাপ আছে যা আমাদের সমাজে প্রকাশ্যে করা হয়, যা এখানে উল্লেখ করা হলো যাতে এসব পাপে লিপ্ত মানুষরা সময় থাকতে সচেতন হয় ও নিজেদেরকে শুধরায়– স্মোকিং, মিউজিক শোনা, গান-বাদ্য, নাটক, মুভি ও সময় নষ্টকারী নিরর্থক খেলাধুলা নিয়ে আলোচনা ও তর্ক করা, হারাম রিলেশনের কথা বলে দেওয়া, গালি-গালাজ করা, গীবত করা, অনুমান বা সন্দেহ করে কাউকে অপবাদ দেওয়া, অপমান করা, দাড়ি শেভ করা, হিজাব না পড়া, ইভ টিজিং করা, অশ্লীল ইশারা-ইঙ্গিত করা, নন-মাহরাম কাযিনদের সাথে মেলামেশা করা ইত্যাদি। আল্লাহ আমাদেরকে এসব অন্যায় ও জাহিলিয়াত থেকে হেফাজত করুক! আমিন!
▣ Written on 25/3/2021 by BEARDFUL