ভদ্রলোকের দুই বিবি | The gentleman has two wives - Islamitune


একটা কালাম খোলাসা করি,
বিষয়বস্তু নিজের পছন্দমত না হলে যে কোনটা অন্যায় আর কোনটা অন্যায় না এটা বিচার করার জ্ঞান হারিয়ে ফেলব, এটা কিন্তু বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয় না। 
 
কেইস- ১
ভদ্রলোকের দুই বিবি। কোনো বিবিই অপরের কথা জানে না। দুই বিবিই নিজ নিজ সংসার নিয়ে সুখি। জামাই বিভিন্ন দ্বীনি ইলম ও দাওয়াতের কাজে জড়িত, তাই তারা উভয়েই জানে তাদের স্বামী প্রতিদিন তাদের কাছে থাকবে না। এই দুই বিবির যে কোনো একজনের সাথে আমার পরিচয় আছে। তার থেকেই তাদের কথা জানা।
যাই হোক, সব সুন্দর মত চলছে। ভদ্রলোক খুবই নেক লোক। যতটুক তার ব্যপারে শুনেছি, সার্বিকভাবে সামর্থ্যবান ও আল্লাহভীরুই মনে হয়েছে।
কোনো এক ভাবে বিপত্তি ঘটল, দুই বিবি একে অপরের ব্যপারে জেনে গেল। এবার শুরু হল অশান্তি। শুরু হল যতসব দুঃখের কথা, একজন মিথ্যেবাদী, ধোঁকাবাজির কথা। মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে কিভাবে প্রথম বিয়ের কথা গোপন রেখে দ্বিতীয় বিয়ে করল সেই কথা। ভাবছি এতদিন তো সব ঠিকই ছিল। স্বামীর অনুপস্থিতির দিনগুলোতে স্ত্রী সবর করে ছিলেন, সন্তুষ্টি ও আমানতের সাথে ছিলেন। সতিন আছে জানার পরেই কেনো অশান্তি শুরু হল?
পুরোটা কাহিনীতে আমার কাছে একটা বিষয়ই অন্যায় লেগেছে, আর তা হল দ্বিতীয় বিয়ের সময় প্রথম বিয়ের বিষয়টা গোপন রাখা। উভয় স্ত্রীকে উভয়ের ব্যপারে জানিয়ে মানিয়ে বিয়ে করলে ভদ্রলোক গোপন হালতে যেভাবে সব মানিয়ে চলছিলেন সেভাবেই চলতে পারতেন বরং আরও শান্তিতে চলতে পারতেন। এক্ষেত্রে আমি স্ত্রীদেরও দোষ দিব না, কারণ এমন অনেক ছেলেই আছে যারা দ্বিতীয় বিয়ের প্রতি কোনো আগ্রহ রাখে না। কিংবা ইনসাফের ভয় করে এক স্ত্রী নিয়েই থাকতে চায়। তাই এমন ছেলেকে স্বামী হিসেবে চাওয়ার অধিকার মেয়েদের আছে। তাই এমনও হতে পারত, এই মেয়ে যদি জানত ভদ্রলোকের স্ত্রী আছে তবে বিয়েতে না করে দিত। 
 
কেইস- ২
ভদ্রলোকের দুই বিবি, কেউই কারও ব্যপারে জানে না। দ্বিতীয় বিয়ের পর প্রথম স্ত্রী ও বাচ্চাদের প্রতি শুরু হয় অবহেলা, অবহেলার এক পর্যায়ে একেবারে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। প্রায় ৩ বছর পর প্রথম স্ত্রী জানেন তার স্বামী আরেক বিয়ে করে সেই বউকে নিয়েই আছে। প্রথম স্ত্রী আমাকে বলেছিলেন, আমার কোনো সমস্যা নাই, থাকুক তার আরও স্ত্রী, আমার কাছে এত আসাযাওয়াও লাগবে না, কিন্তু অন্তত আমার ও বাচ্চার ভরণপোষণ দিক। কিন্তু ভদ্রলোক এতেও রাজি হোন নাই। এবং তাদের তালাক হয়ে যায়। আপাতত ভদ্রমহিলা এক দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে বাচ্চা সহ।
এখানে অন্যায় অনেকগুলো, একাধিক বিয়ে যে কোনো পুরুষের প্রয়োজন হতেই পারে। কিন্তু বিয়ের কথা গোপন রাখা, স্বামী ও পিতা হিসেবে হক আদায় না করা, ইনসাফ না করা, জুলুম করা এইগুলো অন্যায়। বিনা কারণে স্ত্রীকে তালাক দিয়ে তাকে এক কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দেওয়া অন্যায়। এরকম মাসনা কোনো ভাবেই জায়েজ নাই। 
 
কেইস- ৩
প্রথম স্ত্রীর ঘরে সন্তান না হওয়াতে ভদ্রলোক গোপনে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রী প্রথমার কথা জানতেন, বাচ্চা না হওয়ার কারণে বিয়ে করছেন তাও জানতেন, এও জানতেন যে দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছে খুব আগ্রহভরে বাচ্চার স্বপ্ন দেখছেন। বাচ্চা হলেই প্রথমজনকে জানাবেন এবং এই আত্মবিশ্বাস যে বাচ্চার কারণে প্রথমা মেনে নিবেন। যাইহোক, দুই স্ত্রীর সাথেই সুন্দরভাবে সম্পর্ক বজায়ে চলতে পারছেন। ঘটনাক্রমে দ্বিতীয় বিয়ের অল্প কিছুদিন পরেই জানতে পারেন প্রথম স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। এবার শুরু হল দ্বিতীয়ার প্রতি অবহেলা। অবহেলা মানে এমন পরিস্থিতি তৈরি করছেন যেন দ্বিতীয়া নিজ থেকেই বিদায় নেন। কিন্তু দ্বিতীয়া এতিম, ফিরে যাওয়ার জায়গা নাই কোথাও। প্রথমার ঘরে সন্তান হলে দ্বিতীয়াকে জানিয়ে দেওয়া হয় তাকে কখনো বাচ্চা দিবে না, কারণ দুই দিকে বাচ্চা মেন্টেইন করা তার দ্বারা সম্ভব না। বছর ঘুরতেই প্রথমার ঘরে আরেক সন্তান। যাক, বর্তমান হালত অনেকটা এমন, শুধুমাত্র একজন দাসীর মত পড়ে আছে দ্বিতীয়া। একটা মহিলা হোস্টেলে, কিছু টিউশনি করে দিন কাটায়।
এখানে যে কত অজস্র অন্যায় রয়েছে তা আর না লিখি।
আমাদের চারপাশে এমন অনেক অনেক কেইস আছে যেখানে পুরুষদের গোপনীয়তার কারণে, হক আদায় না করার কারণে, না ইনসাফির কারণে, সার্বিক সামর্থ্য না থাকার পরেও একাধিক বিয়ে করার কারণে স্ত্রীরা বাচ্চাদের নিয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। 
 
আবার এমন অনেক কেইস আছে যেখানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে গোপনীয়তা আছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নাই, কিন্তু সার্বিকভাবে সামর্থ্যবান ও ইনসাফ রক্ষা করে চলছে তাও স্ত্রীদের নানান আবেগ, স্বামীর ভাগ দিতে না পারার কষ্ট, হিংসা, ব্লাকম্যাজিক ও প্রয়োজনের অধিক চাহিদার কারণে পুরুষরা হাজার মানিয়ে চলার চেষ্টা করা সত্ত্বেও অশান্তিতে পূর্ণ হতে হতে সংসারগুলো তসনস হয়ে যায়।
এইগুলো অন্যায়। এইসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হওয়া দরকার।
মাসনার প্রতি অনাগ্রহী করে তুলতে আমরা হাদিস থেকে দুইটা দলিল দেই কঠিনভাবে, এক- খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহার জীবিতাবস্থায় হাবিবুল্লাহ দ্বিতীয় বিয়ে করেন নাই। দুই- হাবিবুল্লাহ উনার মেয়ে ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহার জামাইকে বলেছিলেন যেন উনার মেয়ের জীবিতাবস্থায় দ্বিতীয় বিয়ে না করেন। 
 
আমি আশ্চর্য হই এই দুই দলিল দেখলে, জান্নাতের সর্দারনীদের সাথে নিজেদের তুলনা করে ফেলছি! আমরা কি আদৌ খাদিজা ফাতিমা হয়ে গেছি? উনাদের মত আবেদা, সাবিরা, শাকিরা হয়ে গেছি যে উনাদের শানে যা করেছিলেন রাসুলুল্লাহ তা আমাদেরও পাওনা হয়ে গেছে? রাসুলুল্লাহ খাদিজার কাছে যে সুকুন পেতেন আমাদের স্বামীরা আমাদের কাছে সেই সুকুন পান? এক খেজুরে তিনদিন কাটিয়ে দেওয়া ফাতিমার মত সবর আমাদের আছে? রাসুলুল্লাহ কিংবা আলি রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর ইনকামের থেকে বহুগুণ বেশি আমাদের স্বামীদের ইনকাম, উনাদের ঘরে খাদিমা ছিল না, প্রতিদিন ৩ বেলা খাবার ছিল না, দুই/তিনের অধিক কাপড় ছিল না, ঘর ভর্তি ফার্নিচার ছিল না, চুলা, ফ্রিজ, এসি ফ্যান ছিল না, দামী দামী প্রসাধনী ছিল না। 
 
সুরাহ আহজাবের ২৮/২৯ নং আয়াত পড়লে আমরা দেখতে পাই উনারা আখিরাতের সুখের জন্য দুনিয়াবি সমস্ত চাহিদা ত্যাগ করেছিলেন।
আমরা কি উনাদের মত হতে পেরেছি? পারি নি, অথচ উনারা যে মর্যাদা পেয়েছেন প্রথম স্ত্রী হিসেবে, আমরা সেই মর্যাদা দাবী করে বসি। 
 
আর কুরআনের আয়াত থেকে (সুরাহ নিসা-৩)আমরা দলিল দেই যে আমাদের স্বামীরা ইনসাফ করতে পারবে না, এই আগাম বার্তা কিভাবে দিলে পাই? আল্লাহ গায়েব জানিয়ে দেন? ঠিক কতটা হলে আসলে আমাদের চাহিদা পূরণ হয়? বা হবে? ঠিক কতটা হলে আমরা নিজেদের সুখি ভাবতে পারব? ঠিক কতটা হলে আমরা মনে করতে পারব যে আমাদের স্বামীরা এবার আমাদের পুরোটা সময় না কাছে থেকে অন্য স্ত্রীদের কাছে থাকলেও চলবে? 
 
একটু ভেবে দেখেন, আমাদের চাহিদার কোনো শেষ নাই, আমরা কখনো এমন একটা পর্যায়ে যেয়ে স্থির হতে পারব না যেখানে মনে হবে হ্যা, Now I'm full!
খাদিজা-ফাতিমার শানের এই মর্যাদা পেতে হলে আমাদের চাহিদাতেও সেই লাগাম দিতে হবে, যাদের একজন নিজের সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে দিয়েছিলেন, আরেকজন খাদিমার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তাসবিহ, তাহমিদ, তাকবির পাঠ করতেন। যাদের দুয়ারে ভিখারি আসলে নিজেদের খাবারটুকু দিয়ে নিজেরা অনাহারে থাকতেন। আমাদের এমন চাহিদা আর স্বামীর প্রতি সাপোর্টিভ মানসিকতা থাকলে তার না ইনসাফির ভয় আর করতে হত না। কারণ সার্বিকভাবে সামর্থ্যবান ব্যক্তিরাই একাধিক বিয়ের কথা ভাবে। 

বিষয়টা এমন হয়ে গেছে, যেন একাধিক বিয়ে কোনো নির্দিষ্ট একটা দেশের কালচার। একটু জরিপ করে দেখেন, জানতে পারবেন একাধিক বিয়ে কি কোনো নির্দিষ্ট একটা দেশে বা জাতির কালচার নাকি মোটামুটি সব দেশ ও জাতি/ধর্মে আছে। 
 
আমাদের দেশেও ভরপুর, হালাল ভাবে হোক আর হারাম ভাবে, ম্যাক্সিমাম পুরুষই একাধিক নারীতে আসক্ত। কেউ পরোকিয়া করে, কেউ হালাল ও গোপনভাবে একাধিক স্ত্রী রাখছে ও কেউ হালাল ও প্রকাশ্যভাবে একাধিক স্ত্রী রাখছেন। 
 
পুরুষের ফিতরাতই হচ্ছে সে একাধিক স্ত্রীলোকের প্রতি আকৃষ্ট হবে। এটা তার দোষ না, এটা আল্লাহই দিয়েছেন এমন এক সিফাত। সার্বিকভাবে সামর্থ্যবানদের জন্য এই ফিতরাত থেকে নিজেকে বিরত রাখা কঠিন। আর কঠিনের সাথে না পেরেই নানান গুনাহ বা গোপনীয়তার আশ্রয় নেয় তারা।
 
বিষয়টাকে ঘৃণা না, বরং এর প্রতিকার নিয়ে আমাদের সচেতন হওয়া দরকার। সাপোর্টিভ হওয়া দরকার। সবাই সবার স্বামীকে ভালবাসি, ভালবাসার দাবী থেকেই দেখা দরকার, আমার স্বামী কোনো ফিতনায় পড়ছে কিনা, তার একাধিক স্ত্রীর প্রয়োজন আছে কিনা, আমার ভয়ে বা সমাজের ভয়ে সে কোনো গুনাহে লিপ্ত বা গোপন বিয়ে করছে কিনা। উভয় পক্ষ সাপোর্টিভ হলে, সার্বিকভাবে সামর্থ্যবান হলে আমাদের কারই উচিৎ না কারও প্রতি জুলুম করা, কারই উচিৎ না অপরের জন্য দুনিয়ার পথ বা আখিরাতের ময়দান কষ্টকর করে তোলা। 
 
প্রথম বিয়েটা মানুষ যে প্রয়োজনে বা কারণে করে, দ্বিতীয় বিয়েটা করার পেছনেও সেই একই কারণ বা প্রয়োজন আমরা রাখি। এটাই উত্তম। প্রথমাকে ভাল লাগেনা, দেখতে সুন্দর না, বাচ্চা হয় না, শারীরিক /মানসিক সমস্যা, তাই আরেকটা বিয়ে করব এমনটা না করি, এমন করে আমরা মেয়েদের অপমান না করি। অনেক ক্ষেত্রে এমনটা না হলেও কেউ দ্বিতীয় বিয়ে করলে আমরা কিয়াস করে নেই নিশ্চয় প্রথমার এই এই এই খোঁট আছে। 
 
মাসনা নিয়ে লেখার কারণে আমার উপর খেপে যাওয়া মানুষের সংখ্যা এখন হিউজ। আমি কেনো এত ঢাকঢোল পিটাচ্ছি তা নিয়ে চতুর্দিক থেকে গালমন্দ শুনছি। যেন নতুন এক শারিয়া আমি চালু করেছি, যেন এই নিয়ে কুরআন হাদিসে কিছু ছিল না, নবী-রাসুল, সাহাবিদের আমল ছিল না। যেন আমিই এর শুরু আমিই এর গুরু। 
 
আমার দূরদর্শীতা ধরতে পারার মত হিকমা কারও মাঝেই দেখছি না। আমি কোনো অন্যায় করছি না। অন্যায়গুলো কেমন তার ধারণা শুরুতেই দিয়েছি। 
 
আমাকে আমার আহল প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে, তোমার কি হিংসা লাগবে না? কষ্ট লাগবে না? আমি বলি মানুষ এসবের উর্ধ্বে কিভাবে যায়? কেনো কষ্ট লাগবে না? কেনো হিংসা আসবে না? কিন্তু আমি এটা জানি আমার কোন কষ্টকে প্রশ্রয় দিতে হবে কোনটাকে নয়, কোন হিংসা জায়েজ আর কোনটা নয়। এটা আমার নাফসের ব্যপার। এসব নাফসে আসবে আর তার চিকিৎসাও আমি করব। 
 
আমি চাইব না আমার আহলের মাসনার পর কেউ আংগুল তুলুক আমার উপর, আমার আহলের উপর, আমার পরিবারের উপর। আমাকে অসহায়া ভাবুক, আমাকে অপূর্ণ, অসুস্থ ভাবুক, খারাপ ধারণা ও কিয়াস করে নিজেদের গুনাহগার করুক যে নিশ্চয় কোনো সমস্যা আছে তাই আরেক বিয়ে করেছে।
বরাবরই স্রোতের বিপরীত চলে আসছি। এবারও চলছি। যে যে অশান্তির কারণে একাধিক স্ত্রীওয়ালা সংসারগুলো ভেংগে যায় বা জুলুম হয় সেগুলো আগে থেকেই দূর করছি, শুধু ফেসবুকে আমার এই ঢাকঢোল না, বাস্তব জীবনে এর থেকেও আরও বেশি।
 
এগুলো শুধু একটা আদর্শ, সুন্দর, কটুকথাহীন, জুলুম ও কষ্টহীন ইলমের বাগানে ভরপুর বিশাল বড় একটা পরিবারের তৈয়ারি। 
 
আমি এটা আমার জন্য করছি। আমার আগাম পরিবারের জন্য করছি। কাউকে আমার মত করতে বাধ্য করছি না, কেউ আমার মত না করাতে তাচ্ছিল্যও করছি না। 
 
আমার এই আয়োজনে যেসব পুরুষরা তাদের স্ত্রীদের কথা শোনাচ্ছেন আমি বলব এদের দ্বিতীয় বিয়ে না করাই উচিৎ, কারণ এরা গোড়াতেই না ইনসাফি শুরু করেছেন, এদের মাঝে হিকমার অভাব সুস্পষ্ট। 
 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url